এই চল্লিশজনকে বলা হত চল্লিশ চোর। এই উপাধি দিয়েছিলেন কবি আব্দুল গণি হাজারী। অনেক সইদাতা উত্তরকালে অনেক মূল্যে কলঙ্কমোচনের প্রয়াস পেয়েছেন, অনেকে বাংলার স্বাধীনতার পক্ষে মূল্যবান কাজ করেছেন। কিন্তু সঙ্গতভাবেই 'চল্লিশ চোর'-এর অধিকাংশ মুক্তিযুদ্ধে অনতিপ্রচ্ছন্ন রাজাকার ভূমিকা পালন করেছেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন। ... ...
ইতিহাস সাক্ষী, ১৯৭৫ সালের পরে পাহাড়ে গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়। ওই সময় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকার বিদ্রোহ দমনে ব্যবস্থা নেয়। পাশাপাশি পাহাড়ে আদিবাসী ও বাঙালি জনসংখ্যার ভারসাম্য রক্ষার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। সে লক্ষ্যে সমতলের অনেক সেটেলার পরিবারকে দুই একর আবাদি জমি ও পাঁচ একর পাহাড়ি জমি দেওয়ার কথা বলে সরকারি উদ্যোগে তিন পার্বত্য জেলায় পুনর্বাসন করা হয়। সাতের দশকের শেষ ও আটের দশকের প্রথম দিকে বহু সেটেলার পরিবারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আনা হয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বন্দোবস্তের নিয়ম ভেঙে সেটেলারদের জমির কবুলিয়ত দেয়। এ কারণে ভূমি বিরোধ সৃষ্টি হয়। ... ...
২১ অক্টোবর জাতীয় কমিটি লং মার্চ পরিচালনার জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের দলে আমাকে অন্তর্ভুক্ত করে। এটি ছিল কমিটির পক্ষ থেকে আমাকে দেওয়া দারুণ এক চমক উপহার। শরীক দলগুলোর ভেতর থেকে বাছাই করা কর্মী নিয়ে প্রায় ৫০ জন সদস্যের এই স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরী হয়। মেহেদী এই দলের নেতার দায়িত্ব পান। এই দলটিকে মিছিলের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষা, খাবার পরিবেশন, পরিবহন বন্টন, লিফলেট বিতরণ, চিকিৎসা সেবা, গণমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ-- এ রকম দায়িত্ব দিয়ে ছোট ছোট দলে বিভক্ত করা হয়। তিন সদস্য নিয়ে মিডিয়া সেল-এর দল নেতার দায়িত্ব পাই আমি। ... ...
আমার সাথে মিশু আপার যতবারই দেখা হয়েছে ততবারই তিনি, "হ্যালো কমরেড' বলে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করেছেন, কুশলাদি বিনিময় করেছেন। বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে পরস্পরকে অনেকে কমরেড বলে সম্বোধন করেন। আমি কোন বাম রাজনৈতিক দলের সদস্য না তারপরও কেন মিশু আপা আমাকে কমরেড ডাকেন সেটা কখনও জিজ্ঞেস করিনি বা করার প্রয়োজনও বোধ করিনি। কারণ তার সম্বোধনের মধ্যে আছে উষ্ণ আন্তরিকতার প্রকাশ। বেশ কয়েকবার আমি তার বক্তৃতা শুনেছি। আমার কাছে তার বক্তৃতার ঢং ও বেশ আকর্ষণীয় লাগে। তার বেশীরভাগ বক্তৃতার সারমর্ম হয় এরকম- এই রাষ্ট্র, সরকার সবাই হল মালিক পক্ষের। তারা শ্রমিকের রক্ত চুষে আজকে গাড়ী হাঁকায়, এসির বাতাসে ঘুমায়। এই সব লুটেরাদের আমাদের চ্যালেঞ্জ করতে হবে। তাদেরকে আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলতে হবে। শ্রমিক শ্রেণীর জয় সুনিশ্চিত। ... ...
আজকে বিশ্ব ভুত দিবস। রাস্তাঘাটে শত সহস্র ভুত নেমে পড়েছে। হু হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। এর মধ্যে হা হা হি হি করে ভুতের নৃত্য চলছে। কোনো কোনো ভুত অনেকদিন পরে ধরাধামে নেমে প্রকাশ্যে আসায় বুক টান টান করে হাঁটছে। কেউ কেউ শরম পাচ্ছে। একজন বেঞ্জু বাজিয়ে গান গাইছে, হলে হলে । হলে হলে। কুইনসের পথে দুই ভুতের সঙ্গে দেখা। বাঘ ছাল পরে আছে। খাড়া খাড়া দুটো শিং। হাতে একজনের ডম্বরু--আরেকজনের ত্রিশুল। ফুস ফুস করে ওরা সিগারেট টানছে। বললাম, তোমগো বাড়ি কুথায় গো ভুত। ... ...
ভেবেছিলাম লিখবো না, কারণ লিখে খুব কিছু হয় যে সবসময় এমন দাবি করা যাচ্ছে না, এবং শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ফাহমিদা বা গণযোগাযোগ বিভাগের মেধাবী ছাত্রী সুতপার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে লেখালেখি থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে এসব লেখালেখি করে নিজে খানিকটা সান্ত্বনা পাওয়া যায় যে ছিলাম আমিও প্রতিবাদে, এর বাইরে খুব যে কাজ হয় তেমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তবুও আজ লিখছি বা বলা ভালো যে না লিখে পারছি না এই অন্তর্গত তাড়না থেকে যে সত্যিই যখন আজ রুমানা দেশে ফিরেছেন তাঁর ডান চোখের আলো ফিরে পাবার শেষ আশ্বাসটুকু ছাড়াই তখন ওই যে আমিও ছিলাম প্রতিবাদে কেবল সেই গোঁয়ার সান্ত্বনাটুকুর জন্যই হয়তো এই লেখা। ভেতরে কোথায় যেন একটা শুভবোধ কাজ করছিলো যে অন্তত এক চোখের আলো তার ফিরে আসবে। সেই শুভবোধের, আশার ক্ষীণ আলোটিও যখন শেষ হয়ে গেলো, তখন আমি সত্যিই কিছু কালোসিধে কথা বলতে চাই। ... ...
২৪ অক্টোবর। লং মার্চের প্রথম দিন। সকাল ৭ টায় মেহেদীর ফোন আসে। 'সব ঠিক আছে তো ?' ফোন ধরতে ধরতে মনে মনে ভাবি আমি। 'উঠসো ঘুম থেকে? রাস্তায় কিন্তু ভয়াবহ জ্যাম। শিগগির বুড়োর (আনু মুহাম্মদের) বাসার দিকে রওনা দাও। তা না হলে দেরী হয়ে যাবে।' মেহেদীর উৎফুল্ল গলা পাই ফোনের অপর প্রান্তে। এরই মধ্যে সে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। ... ...
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষিকা রোমানা মঞ্জুরের সাথে গত ৫ জুন কি বীভৎস এবং ঘৃণ্য কাজ সংঘটিত হয়েছে সে সম্পর্কে কম বেশি আমরা সকলেই অবগত । কাজেই সে সম্পর্কে আমি নিজে আর বিস্তারিত কিছু বলতে চাইনা, কেবল সম্পূর্ণ বিষয়টিতে আমার নিজের কাছে কিছু অসঙ্গতি চোখে পড়েছে, সেটাই আমি এখানে ব্যক্ত করতে আগ্রহী। প্রথমত, তার সাথে যা হয়েছে সেটা নিয়ে লেখালেখি করতে গিয়ে কিংবা বলতে গিয়ে অনেক জায়গাতেই আমি দেখছি যে বলা হচ্ছে 'তার মত মেধাবী, উচ্চশিক্ষিত একজন নারীর সাথে এরকম ঘৃণ্য কাজ হওয়াটাকে কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায়না' বা এরকম কিছু কথা। এসব কথার অর্থ কী? তিনি যদি 'মেধাবী' কিংবা 'উচ্চশিক্ষিত' না হয়ে থাকতেন তাহলে কি তার বিরুদ্ধে এই আচরণ গ্রহণযোগ্য হতো ? তিনি যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা না হতেন তাহলে কি এই ভয়াবহ আচরণকে অনুমোদন করা যেত ? যখন কারো প্রতি সহানুভূতি জানাতে গিয়ে এরকম স্পর্শকাতর বিষয়ে 'মেধাবী', 'উচ্চশিক্ষিত' এইসকল শব্দ ব্যবহৃত হয় তখন খেয়াল রাখাটা জরুরি, যে যারা 'মেধাবী' কিংবা 'উচ্চশিক্ষিত' হিসাবে সমাজে সেভাবে পরিচিত নন তাদের সাথে এরকম কিছু হলে তখন সেই বিষয়টা প্রান্তিক হয়ে যায়। আমাদের মনে রাখবার দরকার যে কেউ 'মেধাবী', 'উচ্চশিক্ষিত' হোক না হোক কারো সাথেই এমন আচরণ গ্রহণযোগ্য নয় । এখানে ব্যক্তির শ্রেণীগত অবস্থান, সামাজিক অবস্থানের চাইতেও ব্যক্তি স্ব্য়ং বেশী গুরুত্বপূর্ণ , রোমানা মঞ্জুরের সাথে যা হয়েছে সেটা নিয়ে আমরা সকলে যেরকম সোচ্চার সেরকম কিছু আমার বা আপনাদের কারো বোনের সাথে হলেও সকলের সোচ্চার হওয়াটাই কাম্য । এক্ষেত্রে মানুষ নিজে যদি তার সামাজিক অবস্থান , শ্রেণীগত অবস্থানের চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায় তাহলে প্রতিনিয়তই এরকম ঘটনা ঘটে যাবার সম্ভাবনা আরো বেশি । দ্বিতীয়ত, রোমানা মঞ্জুরের নিজের যেই শ্রেণীগত অবস্থান, তাতে তার ১০ বছর ধরে স্বামীর অত্যাচার সহ্য করাটাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে তার নিজের গাফিলতি এবং বস্তাপচা কিছু সংস্কার মেনে চলবার অসমর্থনযোগ্য প্রয়াস হিসাবেই দেখতে পছন্দ করব। ... ...
খেলা শেষে সেই আশাবাদী মানুষটার কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলাম। ভদ্রলোক নির্বিকার মুখে বলল, "ব্যাপার না এটা। বিশ্বকাপের সব গেম কি আমরা একলাই জিতব নাকি? সব দলই তো দুই তিনটা ম্যাচ জিতবে, দুই তিনটা হারবে।' ভেবে দেখলাম কথাটি সত্যি। আজ হেরেছি, কাল জিতব। সেই জেতার দিনের খেলা দেখতে আসার আশা নিয়ে আজ তাই গ্যালারি ছাড়লাম। ... ...
প্রেস ব্রিফিং-এ সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে মাত্র তিনটি প্রশ্ন আসে। প্রশ্নগুলো নির্দিষ্ট কোন তথ্য জানার উদ্দেশ্য থেকে করা হয় না। বরং প্রশ্নগুলো শুনে ধারণা হয় যে এরা উত্তরদাতাদের কাছ থেকে সরকারের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক ও অসহিষ্ণু মন্তব্য কামনা করে। যেমন, একটি প্রশ্ন ছিল সরকার যদি আপনাদের কর্মসূচীতে বাধা দেয় তাহলে আপনারা কি করবেন। আনুষ্ঠানিকভাবে আনু এই প্রশ্নের উত্তরে প্রথমে হাসি দিয়ে প্রশ্নকারীর উত্তেজনা প্রশমন করেন। পরে তিনি ব্যাখ্যা করেন যে সরকার শুধু জাতীয় কমিটির না তার নিজ দলের সমর্থকদেরও ক্ষতি করছে। তাই সরকারী দলের সমর্থকদেরও উচিত তাড়াতাড়ি লং মার্চে অংশগ্রহণ করা। উল্লেখ্য যে ন দিগন্ত, দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টেলিভিশনের মত সরকার বিরোধী পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকদের উপস্থিতি লং মার্চের প্রস্তুউতি পর্বে নিয়মিত ছিল। আর জাতীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ পত্রিকায় লীড নিউজ হবার ফাঁদ থেকে সদা সতর্ক ছিলেন। যেমন এই প্রশ্নটি নিয়েই যখন প্রেস ব্রিফিং পরবর্তী চা চক্রে নেতৃবৃন্দ আলোচনা করেন তখন একজন সরস মন্তব্য করেন, প্রশ্নটা শুনে আমার মাথায় তো একটা শ্লোগান এসেছিল। বাধা দিলে বাঁধবে লড়াই, এ লড়াইয়ে জিততে হবে। আরেক জন মন্তব্য করেন, এই সাংবাদিকরা মনে করে এই রকম ঢ়্ৎড়াড়শরহম প্রশ্ন করলে আমরা বুঝি তোফায়েলের (আওয়ামী লীগের একজন নেতা) মত জবাব দেবো। ... ...
১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন কমিটি তৎকালীন সাংসদ ও জুম্ম জাতির মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (এমএন লারমা) পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসত্ত্বাগুলোকে সংবিধানে অন্তর্ভূক্তির দাবি এবং সংবিধানে পাহাড়িদেরও বাঙালি হিসেবে পরিচিতি দানের প্রতিবাদ বিবেচনায় নেয়নি। ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠেছিল আন্দোলন। সে আন্দোলন এক পর্যায়ে সশস্ত্র আন্দোলনে রূপ নেয়। দীর্ঘ তিন দশকের রক্তক্ষয় আর অর্থ সম্পদ ধ্বংসের পর সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে স্বাক্ষরিত হয় পার্বত্যচুক্তি। সমস্যার কি সমাধান হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তরে আদিবাসীরা বলবেন, "না' "না' "না'। আর আওয়ামীলীগ সরকার বলবে "হ্যঁ¡' । ... ...
সমাবেশস্থলে পৌঁছে প্রথমেই আমার নজরে পড়ল পথসভায় যোগদানকারীদের পায়ের কাছে পড়ে থাকা হলুদ রঙের গাঁদা ফুলের পাপড়ির ওপর। বুঝলাম জাতীয় কমিটির স্থানীয় কর্মীরা ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে লং মার্চের যাত্রীদের স্বাগত জানিয়েছেন। খেয়াল করে দেখি শাড়ী পরা, পরিপাটি করে চুল বাঁধা, আর কপালে মেরুন রঙের টিপ পরা একজন তরুণী তখনও একটি ডালা থেকে ফুলের পাপড়ি ছিটাচ্ছেন। ফুল দিয়ে অতিথিদের বরণ করে নেওয়ার রেওয়াজটি এর আগে আমি বিয়ে আর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে দেখেছি। এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ এটিই আমার প্রথম। তাই এক্ষেত্রেও রেওয়াজটি সাধারণ কি না তা নিয়ে আমার মনে সন্দেহ দেখা দিল। তবে স্কুলে থাকতে টেলিভিশনে দেখতাম, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সামরিক শাসক হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদকে গলায় ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হত। সে এতো মালা পেত যে তাতে তার মুখ ঢাকা পড়ে যেত। ... ...
পথে ঘাটে উত্যক্তকারী বললে চর্যাপদীয় শোনায়। এক সময়ে এটাকে টন্টিং বলা হতো। মামুদের দেখতাম জিনস পরে বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে গীটার বাজাতে। আর শিস দিতে,মাউথ অর্গান বাজাতে। রাজেশ খান্নার মেরি সপনেকি রাণী তুমি আওনাকো দেখে বাপ চাচাদের প্রজন্মের চারুচর্চার লক্ষণ দেখেছি। দাদুদের অশোক কুমারো কম ছিলেন না। ... ...
শর্মিলা বোসের "সিভিল ওয়ার' তত্ত্বের ভুল হলো তা পাকিস্তানকে একটি জাতিরাষ্ট্র ভেবেছে এবং মুসলমানিত্বকে সেই জাতিরাষ্ট্রের ঐক্যসূত্র ধরে নিয়েছে। যে পাকিস্তান মুসলমানদের একজাতি বলেছে, সে নিজেই আবার বাঙালি মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েপ্রমাণ করেছে, তারা এক জাতি নয়। ব্রিটিশ ভারতে মুসলিম ঐক্যটা কংগ্রেসি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সাময়িক রাজনৈতিক কৌশল ছিল, এবং রাজনৈতিক কারণেই হিন্দু জমিদার শ্রেণীর ভীতি অপসারিত হওয়ায় ঐক্যটাও প্রয়োজন হারিয়েছে এবং পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে। একে দেশভাগ বলে না, বলে ভাঙ্গন এবং তা রাষ্ট্রের ভাঙ্গন। এর মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্র পেয়েছে তার আসল রূপ। যে রূপটা বণিক-সামরিক পাঞ্জাবি এলিটতন্ত্রের, যা ব্রিটিশ-মার্কিনের ঔপনিবেশিক জের বহন করছে, ঔপনিবেশিক ব্রিটেন আর সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার উত্তরাধিকার ও রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে কাজ করছে। আর বাংলাদেশের আবির্ভাব এই জোটেরই বিরুদ্ধে। যে কোনো রকম উপনিবেশিকতা ও আঞ্চলিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে ভাষাভিত্তিক, সেক্যুলার, কৃষকমেজাজি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে। এটাই নিশ্চয় এই রাষ্ট্রের মকসুদে মঞ্জিল নয়, তবে সেটা অন্য আলোচনা। এখন কেবল এই সত্যটা আমাদের মনে থাকা চাই দ্বিজাতিত্ত্বের মিছা আশা এবং ভারতবর্ষীয় একজাতিতত্ত্বের মায়ার নাগপাশের বাইরে এর আবির্ভাব হয়েছিল। আর মান্য করা চাই যে, এই রাষ্ট্রের ভিত নির্মিত হয়েছে সংগ্রামে, রক্তে, অশ্রুতে আর আগুনে। যার সম্মান ও সার্থকতা আজ অবধি আমরা দিতে পারি নাই। সংশোধনবাদী ইতিহাস চর্চা এরই সুযোগ নিচ্ছে এবং নিতে থাকবে। ... ...
আমাকে রক্ষা করতে আমার মা জননী একদিন দক্ষিণ দেশে চলে এল। রীতিমত উন্মাদ দশা। আমাকে যে বাঘে খায় নি, কুমোইরে খায় নি, বা ডাইনীতে কাঁচা গেলে নি দেখে তার ধড়ে প্রাণ ফিরে এল। রক্ষাকালীর উদ্দেশ্যে পাঁচসিকে মানত করে বসল। বলল, বাবা, তোর এখানে থাইকা কাম নাই। বাড়ি ফিরে চল। ছেলেকে নিয়ে ঘরে দোর দিয়ে বসে আছে স্নেহময়ী মা। জানালাও আটকেছে শক্ত করে। চোখে ঘুম নাই। দরোজায় শব্দ হল। মার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। খুলতে গেলে হাত চেপে ধরেছে। বলছে, খুলিস না। খুলিস না। ডাকাইত। ডাকাইত আইছে। ডাকাইত না। প্রতিবেশী বৌদি এসেছেন। হাতে পাকা আমের ঝুড়ি। খেয়ে মা বলল, অ মা, এ দেহি আম--মিঠা। ... ...
শর্মিলার থিসিস বা চিন্তা আর পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ও তার দেশীয় দোসরদের চিন্তা একাকার হয়ে যায়। এ কারণেই শর্মিলা বোসের ইতিহাস এক বিষাক্ত ইতিহাস। তিনি বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসকেই বদলে দিতে চান। তিনি দিচ্ছেন নতুন সৃষ্টিতত্ত্ব বা জেনেসিস। এটাই তাঁর আগ্রহের মূল প্রণোদনা, তাঁর লক্ষ্য এবং এ জন্য তিনি সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও অরক্ষিত জায়গায় আঘাত করেছেন। জয়া চ্যাটার্জি বেঙ্গল ডিভাইডেড বইয়ে ১৯৪৭ এর বঙ্গভাগের জন্য ভারতীয় কংগ্রেস এবং হিন্দু সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদকে দায়ি করেন, দায়ি করেন তাদের সংখ্যাগুরু বাঙালি মুসলমান কৃষকের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি না করার মানসিকতাকে। আর শর্মিলা বোস করেন তার বিপরীত, পাকিস্তান-ভাগের জন্য অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদকে দোষী করেন, কারণ তা সংখ্যালঘু পাঞ্জাবী শাসকদের অধীনস্ততা মানতে চায়নি। জয়া চ্যাটার্জির কাজ যেখানে প্রগতিশীল অবস্থান থেকে ইতিহাসের বিনির্মাণ, শর্মিলা বোসের কাজ প্রতিক্রিয়াশীল জায়গা থেকে বিনির্মিত বিমানবিক ইতিহাস হয়ে ওঠে। কিন্তু বাংলা ভাগ আর পাকিস্তান ভাগ এক ঘটনা নয়। কারণ বাঙালিরা এক জাতি কিন্তু পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীরা ধর্মে এক হলেও জাতিতে এক নয়। শর্মিলা বোস তাঁর ঘোরগ্রস্ত চোখে তাদের এক জাতি ঠাউরেছেন বলেই পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানী উপনিবেশ কায়েম তাঁর চোখে পড়ে না, বাদ পড়ে যায় একাত্তরের আগের ২৪ বছরের বঞ্চনা ও সংগ্রামের ইতিহাস। এজন্য ই স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়ে যায় "গৃহযুদ্ধ' আর হানাদার ও মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি এক পাল্লায় তুলে পরিমাপ করেন। কারণ তাঁর পাল্লা একটাই, দৃষ্টিও একরোখারকম সংকীর্ণ। একাত্তরের আগের স্বাধীনতা সংগ্রামকে "বিচ্ছিন্নতাবাদী ষড়যন্ত্র' হিসেবে দেখেন বলেই বাঙালিদের ওপর চালানো গণহত্যা ও গণধর্ষণের অভিযোগ হয়ে ওঠে "অতিরঞ্জন' এবং বাঙালিদের বাড়াবাড়ির "মানবিক' প্রতিক্রিয়া। ... ...
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একাত্তরের পরাজিত শক্তি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। সে হত্যা একাত্তরে বাংলাদেশের অর্জনকেই হত্যা করার নামান্তর। তার পর থেকেই বাংলাদেশের পাকিস্তানের ভূতের দিকে যাত্রা চলছে। জিয়া এরশাদের সামরিক শাসন, একনায়কতান্ত্রিক শাসন, খালেদা-হাসিনার দায়িত্বহীন রাজনীতি একাত্তরের অর্জনের কাছে আর রাষ্ট্রকে ফেরাতে দিচ্ছে না। মানুষের আশা ভরসার স্থানটি গেছে। এখন মানুষ আশঙ্কা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না। নানাবিধ বিভেদের শিকার হচ্ছে। আবার বাংলাদেশের মানুষ আত্মপরিচয়ের সংকটে পড়ে গেছে। এর পিছনে বঙ্গবন্ধুরও কিছু ভুল রাজনীতি ছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশ অগ্রজ ইতিহাসবিদ প্রফেসর সালাহ্উদ্দিন আহমদ সম্প্রতি কিছু কথা বলেছেন বাংলাদেশর লেখক সাংবাদিক মশিউল আলমের সঙ্গে। বর্তমান আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের নানারকম প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকাণ্ডের কারণে নানারকম প্রশ্ন উঠছে বঙ্গবন্ধুর ভুমিকা, কর্মকান্ড ও আদর্শ নিয়েও। এমনও প্রশ্ন আসছে যে বঙ্গবন্ধু আসলেই বাংলাদেশ চেয়েছিলেন কিনা, কিম্বা স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে তাঁর অবদান আসলেই কতটুকু? এমন নানা প্রশ্নের উত্তর মেলে মশিউল আলমের নেওয়া প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ সালাহ্উদ্দীন আহমদ-এর সাক্ষাতকারটিতে। সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্য। ... ...
সিডরের ভয়ঙ্কর আঘাতে যে লাখ লাখ মানুষ সর্বস্ব হারিয়েছে তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতা। সম্প্রতি দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে একশনএইড পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৪২টি ক্ষুদ্রঋণদানকারী সংস্থা সেসব অঞ্চলে কাজ করছে এবং ১৫ লাখ মানুষের কাছে প্রায় ১ হাজার ২শ কোটি টাকা ঋণ আছে। এসব সংস্থার মধ্যে ব্র্যাক, আশা ও গ্রামীণ ব্যাংকও আছে। একই গবেষণায় দেখা গেছে, ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ এতই প্রবল ছিল যে, অনেকেই প্রাপ্ত রিলিফ সামগ্রী, সরকার প্রদত্ত গৃহনির্মাণ সুবিধা বিক্রি করে কিস্তি শোধ করেছেন। অনেকে নতুন ঋণ নিয়ে পুরনো কিস্তি শোধ করেছেন। এই চিত্র অস্বাভাবিক বা বিচ্ছিন্ন নয়। গত বছরে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণাপত্রে লামিয়া করিম নাকছাবি গরম্ন, মুরগি, ঘরের টিন, আসবাবপত্র বিক্রি করে ঋণের কিস্তি পরিশোধের একাধিক উদাহরণ দিয়েছেন। এ ধরনের বহু ঘটনার সাক্ষী বহু গবেষক ও সাংবাদিক যার অল্পই প্রকাশিত। ... ...
স্থানীয়, জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক স্তরে ড: ইউনুসের সমালোচক বা সমর্থক উভয় দলই সংখ্যায় বেশ ভারী। ৫ মার্চ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এজেন্সি, মানবাধিকার সংগঠন, মার্কিন স্বরাষ্ট্র দপ্তর ও অন্যান্যদের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পাঠানো একটি ইমেইলে হাসিনা তনয় সজীব ওয়াজেদ লিখছেন যে বাংলাদেশে ইউনুসের একমাত্র পরিচিতি নোবেল পুরষ্কার প্রাপক হিসেবে। রাজনৈতিক ভাবে তাঁর কোনও অস্তিত্ব নেই। গ্রামীণ ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে বিশাল আর্থিক দুর্নীতি, কর ফাঁকি ও তহবিল তছরুপের অভিযোগ এনে সজীব জানাচ্ছেন এর প্রত্যেকটিই ফৌজদারি অপরাধ হওয়া সত্বেও বাংলাদেশ সরকার ইউনুসের বিরুদ্ধে কোনওরকম শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। সরকারের একমাত্র লক্ষ্য হল ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের আরও শোষনের হাত থেকে বাঁচানো। ... ...
সারা পৃথিবীতেই চলছে খনি/ভূ-সম্পদ/ শিল্পায়নের নামে ভূমি অধিগ্রহণের লুটেরাদের পুঁঁজির খেলা। বেশী দূর না- "হাতের কাছের হয়না খবর/ কি দেখতে যাও দিল্লি-লাহোর' হলেও আমাদের সামনে উদাহরণ হিসেবে আছে ভারতের নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, লালগড়। উন্নয়নমূলক কাজকর্ম বা শিল্পায়নরে জন্য কৃষিজমি অধিগ্রহণ করতে উদত্য হওয়া সংসদীয় ধরার সুপার-ডুপার বামদের সিঙ্গুরের মতো বছরে পাঁচ ফসলি জমি তুলে/ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে সেখানে কারখানা/সেজ(SEZ)/ কেমিক্যালহাব/ মোটরস কারখানাসহ নানা জাতের শিল্পায়নের দোহাই দিয়ে পাঁয়তারা করেছেন। (অথচ, সিপিএম নাকি সাম্যবাদের গান গায় , আসলে কার্যত পুঁজির দাস। ধান্ধায় ডুব দিলে ঘিলু কি আর ঠিক থাকে?) সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের নিরস্ত্র শোষিত জনতা তা মেনে নেয়নি। অত্যাধুনিক রাইফেলের বাটের ঠেলা/ গুলি খেয়ে/ ধর্ষিত হয়েও দাব্বাড়েছে "ফিকে লালবাহিনী'র গুন্ডাদের/পুলিশদের-। তারা কৃষিজমি অধিগ্রহণ করতে চেয়েছে মূলত তথাকথিত "শিল্পায়ন' এবং স্পেশ্যাল ইকোনোমিক জোন গড়ে তোলার জন্য যার প্রধান উদ্দেশ্য হল পুঁজিপতির শ্রমিকশ্রেণীকে ইচ্ছামত শোষণ করার উপযুক্ত বিশেষ সুবিধা এবং অধিকার সুনিশ্চিত করা- যে খায়েশ গুড়িয়ে দিয়েছে সিঙুর এবং নন্দীগ্রামের মানুষ। তবুও নীলনকশা থামে না-। "অপারেশন নন্দীগ্রাম' , বা আজকের 'অপারেশন গ্রিনহান্ট'- শুধুক্রোধ, পাশবিকতা; শুধু ঘৃণা, তাল তাল ও জমাট বাঁধা- কালো, যতটা কালো হতে পারে জমাটবাঁধা রক্ত, মানুষের রক্ত, নকশালীরক্ত খুবলে খাচ্ছে। ... ...